Honey Blog

মধুঃ চাষ বনাম অচাষ

চাষ করা মধু এবং প্রাকৃতিক মধু এই দুটোর মধ্য কি কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়?

অন্যদিকে চাষ করা মধুর বাক্সের পাশে গলানো চিনির ড্রাম বা পাত্র রাখা হয় এ ক্ষেত্রে এটাতো‌ ফুল থেকে নেয়া নয় তাহলে এই মধুর গুনাগুন আর প্রাকৃতিক মধুর গুনাগুন কি সমান হবে?

মৌমাছি কয়েক জাতের হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রধানত তিনটি প্রজাতির দেখা মেলেঃ

bees

১। এপিস ডরসাটা (Apis dorsata) :

বড় বড় মৌমাছি। সাধারণত বন-জঙ্গলে বড় গাছ কিংবা পাহাড়ের গায়ে একেবারে প্রকাশ্যেই ইয়া বড় চাক বানায়। মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে। একেকটা মৌচাক থেকে বছরে ৩৫-৩৭ কেজি মধু পাওয়া সম্ভব।

২। এপিস সেরানা ইনডিকা (Apis cerana indica) :

আকারে একটু ছোট। স্বভাব চরিত্র অপেক্ষাকৃত মোলায়েম। আমাদের চারপাশে যেসব মৌমাছি দেখা যায় তাদের অধিকাংশই এই প্রজাতির। এরা একটা বড় চাক না বানিয়ে আকারে ছোট, একাধিক সমান্তরাল চাক বানায়। এদের চাকগুলো লুকানো থাকে, যেমন পাহাড়ের গুহা, গাছের কুঠরী, দেয়ালের চিপায়… এদের পোষ মানানো যায়, তবে পোষ মানে কম। মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে নিজের মৌচাক ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। এদের একেকটা কলোনী থেকে বছরে ২-৫ কেজি মধু পাওয়া সম্ভব।

৩। এপিস মেলিফেরা (Apis mellifera) :

ইনারা বিদেশী মৌমাছি, উৎস ইতালীতে। এপিস ইনডিকা থেকে বড়, কিন্তু এপিস ডরসাটা থেকে ছোট। ভারী পরিশ্রমী জাত। মধু পেলেই ছোটে জোগাড় করতে। মানুষের সাথে খাতির-ও ভালো। তেড়েফুড়ে আসে না, আবার সংসার বিবাগী হয়ে অন্য কোথাও হারিয়ে যায় না। সারা দুনিয়ার মৌমাছি লালন-পালনকারীরা এই জাতটাকে পোষে। এদের উৎপাদন-ও ভালো। ফুলের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে একেকটা কলোনী ৪৫ থেকে ১৫০ কেজি পর্যন্ত মধু সংরক্ষণ করে রাখতে পারে।

এখন আমরা কী বলব, যে এপিস ডরসাটার মধুটা প্রাকৃতিক আর বাকিগুলো নয়?

না, সবগুলো মধুই প্রাকৃতিক। চাষের মধুর মতো চাকের মধুকেও সামান্য উত্তাপ দেওয়া হয় যাতে মধুতে মিশে থাকা মোম আলাদা করা যায় এবং একটু ঘন করা যায়।

সারা বাংলাদেশের খুব সামান্য কিছু মানুষ প্রসেসিং ছাড়া মধু বিক্রি করেন।

প্রসেসিং ছাড়া মধু সাধারণত পাতলা হওয়ায় একে নকল মধু হিসেবে ভুল করেন অনেকে। এই ঝামেলা এড়াতেই মধুর প্রসেসিং।

বড় বড় কোম্পানি যেমন ডাবুর বা এপি, এরা বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ফুলের মধু সংগ্রহ করে একটা নির্দিষ্ট আর্দ্রতা এবং ঘনত্বে প্রসেস করে। এতে এদের মধু সবসময় একই রকম হয়। কিন্তু সরোবরের বিক্রি করা ‘আসাল’ মধু বিভিন্ন ফুল গাছের ক্ষেতে বসানো চাক থেকে সংগ্রহ করা। এতে মধুগুলোতে রকমফের হয়। আমরা এখন মধুকে সামান্য প্রসেস করে বিক্রি করি – মোমটা তুলে ফেলে দেওয়ার জন্য যতটুকু তাপ দেওয়া দরকার, দেওয়া হয়। তবে আমাদের ইচ্ছে আছে, সামনে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক অর্থাৎ কাঁচা মধু বাজারে আনার। সে জন্য আমাদের একটা গবেষণা প্রকল্প চলছে।

এবার আসি চিনিপানি খাওয়ানোর প্রসংগে।

মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে সঞ্চয় করে নিজেদের খাওয়ার জন্য। কেন?

কারণ বছরের একটা বড় সময়, বর্ষাকালে ফুল ফোটে কম। ফুলের সময় শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম। মাঠের মৌয়ালরা যখন একটা মধুর চাক কেটে নেন তখন মৌমাছিদের কী হবে চিন্তা করেন না। কিন্তু মধুচাষীরা নিজেদের পোষা মৌমাছিদের যত্ন নেন। যদি ফুল না থাকে তখন মৌমাছিদের থেকে মধু সংগ্রহ দূরে থাক, তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। চিনি বা গুড়মেশানো পানি আসলে সেই প্রচেষ্টার অংশ। ফুলের নেকটারে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে, খনিজ উপাদান আছে সেগুলোতো আর চিনিতে নেই। তাই চিনিপানি খেয়ে মৌমাছি কোনোমতে বেঁচে থাকে – ঐ সময়টাতে সে মধু উৎপন্ন করে না।

তাহলে মধু উৎপন্ন হয় কীভাবে?

যখন সরিষা ফুল ফোটে, তখন মৌচাষীরা তাদের বাক্স-প্যাটরা নিয়ে তাবু গাড়ে সরিষা ক্ষেতে। যখন লিচু ফুলের সময় তখন মৌবাক্সগুলো নিয়ে যায় দিনাজপুরের লিচুবাগানে। এমনি করেই সংগ্রহ করা হয় বরই ফুলের মধু কিংবা কালিজিরা ফুলের মধু। সরোবরের বিক্রি করা সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা হয় সুন্দরবনের কাছকাছি পেতে রাখা মৌবাক্সগুলো থেকে।

শেষকথাঃ

আমরা বলছি না সব মধু সমান। ঘরে পালা মুরগি আর বনমোরগের মধ্যে তফাত তো আছেই। অচাষকৃত মৌমাছিদের চাকে নাম-না-জানা বুনো ফুলের মধু থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে শুধু সেটার ওপরে ভরসা করতে হলে সবার ভাগ্যে মধু খাওয়া জুটবে না, আর দাম-ও হবে আকাশছোঁয়া।

আমরা তাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু চাষাবাদের পক্ষে। তাতে মধুর দামটা যেমন হাতের নাগালে থাকে আর অনেকগুলো ফসলের পরাগায়ন হয়, ফসলের প্রাকৃতিক উৎপাদন বাড়ে। আমরা শুধু লক্ষ্য রাখি কোনো ভেজাল যেন না মেশে কোথাও। মানের যেন পড়তি না হয়।

One thought on “মধুঃ চাষ বনাম অচাষ

  1. Shamima Akter says:

    Alhamdulillah. Very nice & informative. BarakaAllahu.

Comments are closed.