যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমলসমূহ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার সৃষ্টির মধ্যে কিছু মানুষদের যেমন অন্য মানুষদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন (নবী-রসুল বনাম সাধারণ মানুষ), কিছু স্থানকে যেমন অন্য স্থানের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন (মক্কা-মদীনা বনাম অন্যান্য শহর), তেমন কিছু সময়কে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন।
সময়ের মধ্যে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনকে আল্লাহ তা’আলা অনেক বেশি ফজিলত দিয়েছেন। তিনি কুরআনুল কারীমের সূরা ফাজরে কসম করে বলেছেন,
وَلَیَالٍ عَشۡرٍ ۙ وَّالشَّفۡعِ وَالۡوَتۡرِ ۙ
দশ রাতের এবং জোড় ও বেজোড়ের কসম।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
এটা সেই দশ দিন; যে দিনগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সূরা ফজরে শপথ করেছেন। আর জোড় হল যিলহজ্জর ১০ তারিখ আর বেজোড় আরাফার দিন, যা যিলহজ্জ এর ৯ তারিখ হয়ে থাকে।
(মুসনাদে আহমদ ১৪৫১১ ও মুস্তাদরাক হাকেম ৭৫১৭)
নবী (ﷺ) থেকে বলেন,
“অন্য যে কোন সময়ের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর তথা দশদিনের নেক আমল অধিক প্রিয়। তারা (সাহাবীরা) বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়!! তিনি বলেন: আল্লাহর পথে জিহাদও নয়; তবে কোন লোক যদি তার জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এবং কোন কিছু নিয়ে ফেরত না আসে সেটা ভিন্ন কথা।”
[সহিহ বুখারী (২/৪৫৭)]
এ দশটি দিন বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে উত্তম; এমনকি রমযানের শেষ দশ দিবসের চেয়েও উত্তম। তবে, রমযানের শেষ দশরাত্রি যিলহজ্জের দশরাত্রির চেয়ে উত্তম; যেহেতু ঐ রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর আছে, যে রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম।[তাফসীরে ইবনে কাছীর (৫/৪১২)]
যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের যে আমলগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ:
(১) রোজা রাখা
যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) ৯ দিন রোযা রাখা মুসলিমের জন্য সুন্নত। কেননা নবী (ﷺ) এ দশদিনে নেক কাজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। রোযা রাখা নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত। রোযাকে আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন। হাদিসে কুদসীতে এসেছে-
“বনী আদমের সকল আমল তার নিজের জন্য শুধু রোযা ছাড়া। রোযা আমারই জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দিব।”
[সহিহ বুখারী (১৮০৫)]
নবী (ﷺ) যিলহজ্জ মাসের ৯ দিন রোযা রাখতেন। হুনাইদা বিন খালিদ থেকে তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে নবী (ﷺ) এর জনৈক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) ৯ দিন, আশুরার দিন ও প্রতিমাসে তিনদিন রোযা রাখতেন। মাসের প্রথম সোমবার ও প্রথম দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।
[সুনানে নাসাঈ (৪/২০৫) ও সুনানে আবু দাউদ (২/৪৬২)]
জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা; বিশেষত আরাফার দিনের রোজা রাখা।
রাসূল(ﷺ) বলেন,
‘‘আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা বিগত বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’’
[মুসলিম ১১৬২]
(২) কুরবানি করা
নবী (ﷺ) বলেন,
“যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কোরবানী করেনি সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়”
[সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১২৩]
নবী (ﷺ) আর বলেন,
“প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি কোরবানী দেয়া ওয়াজিব”
[মুসনাদে আহমাদ ২০২০৭]
ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুমাল্লাহ এর মতে কুরবানি করা ওয়াজিব। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম মালিক এবং ইমাম শাফিঈ রাহিমাহুমাল্লাহ, দের মতে কুরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
যারা বাংলাদেশে হানাফি মাযহাব অনুসরণ করেন তাদের কাছে ঈদের তিনটি দিন যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে তাকে কুরবানি করতে হবে। যাদেরই সম্পদ নিসাব পার হবে তাদের উপরই কুরবানি ওয়াজিব হবে। গরুর একটা ভাগ কিংবা একটা ছাগল/ভেড়া দিলেই এই ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। আপনি যদি হানাফি মাযহাব অনুসরণ করেন তাহলে আপনার উচিত সামর্থ্য কম থাকলেও কষ্ট করে হলেও কুরবানি করা।

(৩) নখ ও চুল না কাটা
যারা কুরবানির নিয়্যাত করেছেন তাদের জন্য এই দশ দিন নখ ও চুল না কাটা উত্তম।
যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর যে ব্যক্তি কোরবানী করতে চান তার জন্য চুল কাটা, নখ কাটা কিংবা চামড়ার কিছু অংশ কাটা হারাম হয়ে যায়। দলিল হচ্ছে সহিহ মুসলিমে (১৯৭৭) উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন তোমরা যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কোরবানী করার ইচ্ছা রাখে তখন সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” অন্য এক ভাষ্যে আছে: “যখন (যিলহজ্জ) মাসের (প্রথম) দশক শুরু হয় ও তোমাদের কারো কোরবানী করার ইচ্ছা থাকে সে জন্য তার চুল ও চামড়ার কিছু না কাটে।”
ইমাম নববী বলেন: “কোরবানী করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যিলহজ্জের প্রথম দশকে প্রবেশ করলে (তার চুল কাটা সংক্রান্ত) এ মাসয়ালায় আলেমগণ মতভেদ করেছেন। সাঈদ বিন মুসায়্যিব, রাবিআ, আহমাদ, ইসহাক, দাউদ ও শাফেয়ির ছাত্রদের কেউ কেউ বলেন: এমন ব্যক্তির জন্য কোরবানীর সময় কোরবানী করার আগ পর্যন্ত চুল ও নখ কাটা হারাম। শাফেয়ি ও তাঁর ছাত্রগণ বলেন: এটি মাকরুহে তানযিহি; হারাম নয়…।”[শরহে মুসলিম]
এ বিধানটি কোরবানী করতে ইচ্ছুক নর-নারী সকলের জন্য সাধারণভাবে প্রযোজ্য।
শাইখ বিন বায (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “যে নারী তার পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী করতে ইচ্ছুক কিংবা তার পিতামাতার পক্ষ থেকে কোরবানী করতে ইচ্ছুক যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক প্রবেশ করলে তার চুলের ব্যাপারে কি করা জায়েয?”
জবাবে তিনি বলেন: “তার জন্য চুল খোলা ও ধৌত করা জায়েয; কিন্তু চিরুনী করা জায়েয নয়। চুল খোলার সময় কিংবা ধোয়ার সময় কিছু চুল ঝরে পড়লে কোন অসুবিধা নেই।”
[ফাতাওয়া শাইখ বিন বায (১৮/৪৭)]

(৪) যিকির করা
যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে ৪ ধরনের যিকিরে লেগে থাকা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয় একটি আমল। রাসুল (ﷺ)বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট যিলহজ্জ মাসের দশ দিনের আমলের চেয়ে মহান এবং প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং, তোমরা সেই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে
তাসবিহ ( سُبْحَانَ اللّٰهِ ),
তাহমিদ ( ٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ ),
তাহলিল ( لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ )
তাকবির ( اللّٰهُ أَكْبَر )
পড়ো।’’
[আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৫৪৪৬; হাদিসটির সনদ সহিহ]

(৫) তাকবির বলা
বেশি বেশি তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা।

সাধারণভাবে এই দশ দিন সংক্ষেপে اللّٰهُ أَكْبَر বেশি বেশি পড়ুন। সাথে, নিচের বাক্যগুলোও সাধ্যানুসারে পড়ুন।
اَللّٰهُ أَكْبَرْ اَللّٰهُ أَكْبَرْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرْ اَللّٰهُ أَكْبَرْ وَلِلّٰهِ الْحَمْد
অর্থ: আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ; আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
এটি ইবনু মাস‘উদ (রা.) ও অন্যান্য পূর্বসূরিদের থেকে প্রমাণিত।
[দারাকুতনি, আস-সুনান: ১৭৫৬; আলবানি, ইরওয়াউল গালিল: ৬৫৪ সনদ সহিহ]
তবে, আরাফার দিন অর্থাৎ যিলহজ্জর ৯ তারিখ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একাকী বা জামাতে নামাজ আদায়কারী, নারী অথবা পুরুষ—প্রত্যেকের জন্য একবার তাকবিরে তাশরিক (উপরে বর্ণিত তাকবিরটি) পাঠ করা ওয়াজিব। পুরুষরা উচ্চ আওয়াজে বলবে, আর নারীরা নিচু আওয়াজে।
[ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমু‘উ ফাতাওয়া: ২৪/২২০; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ: ২/৩৬০; ইবনু আবিদিন, রাদ্দুল মুহতার: ৩/৬১]
আল্লাহর তাসবীহ (স্তুতি), তাহলীল (লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ) এবং তাকবীরের ফযীলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“মি‘রাজের রাতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মাতকে আমার সালাম বলো এবং তাদেরকে এ সংবাদ দাও যে, জান্নাতের মাটি সুন্দর, পানি মিষ্টি, আর জান্নাত সমতল এবং এর বৃক্ষরাজি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার”।
[সুনানে তিরমিযি]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, গরীব মুহাজিরগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন. ধনী ও বিত্তবান লোকেরা তো আল্লাহর নিকট সুউচ্চ মর্যাদা এবং নানাবিধ নি‘আমত লাভে ধন্য হয়ে গেল।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কীভাবে? তারা জবাব দিলেন যে, আমরা যেমন সালাত আদায় করি তারাও সালাত আদায় করে। আমরা যেমন সাওম পালন করি তারাও সাওম পালন করে। কিন্তু তারা দান সদকা করে আমরা তা করতে পারি না। তারা গোলাম আযাদ করে আমরা তা করি না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দেব, যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের সমকক্ষ হবে, আর তোমাদের পরবর্তীদের চেয়ে অগ্রগামী হবে? আর তোমাদের চেয়ে উত্তম কেউ হবে না, সে ব্যক্তি ছাড়া যে তোমাদের মতোই এ কাজগুলো করবে।
তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে সে কাজ শিক্ষা দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, আর ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে”। [সহীহ মুসলিম]
(৬) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
চারটি সম্মানিত মাসের একটি হলো যিলহজ্জ; তাই এই মাসের সম্মানে যথাসম্ভব সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত ফলকে (বছরে) মাসের সংখ্যা বারোটি—আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে চারটি (মাস) সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা (গুনাহ করার মাধ্যমে) নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।”
[সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৩৬]
শাদ্দাদ ইবন আউস রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য নেক কাজ করেছে। আর অক্ষম সেই যে নিজের নফসকে প্রবৃত্তির পেছনে পরিচালিত করে এবং আল্লাহর কাছে কেবল প্রত্যাশা করে।’
[তিরমিযি ২৪৫৯]
নফসকে নিয়ন্ত্রণের অর্থ হলো, গুণাহ করতে ইচ্ছা করলেও তা থেকে বেঁচে থাকা এবং সৎ কাজ করতে ইচ্ছা না করলেও করা।
কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসে বলেছেন, প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফস তথা মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং প্রবৃত্তির সকল চাহিদার পেছনে না চলে নফসকে আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুগামী বানায়, মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এর ব্যতিক্রম হলে সে নির্বোধ-বোকা। কারণ সে সারাটা জীবন অর্থহীন কাজে ব্যয় করল কিন্তু চিরকাল যেখানে থাকতে হবে তার জন্য কোনো পাথেয় সংগ্রহ করল না।
কবিরা গুনাহগুলো থেকে বেচে থাকলে ছোট গুনাহ এমনিতেই মুছে যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
‘যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, যদি তোমরা সেসব বড় গোনাহ গুলো থেকে বেঁচে থাকতে পার। তবে আমি তোমাদের (ছোট) গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেব এবং সম্মান জনক স্থানে তোমাদের প্রবেশ করাবো।’
(সুরা নিসা, আয়াত : ৩১)
আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন,
‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমাযান থেকে আরেক রমাযান এতদুভয়ের মাঝে সংঘটিত সমস্ত পাপ রাশির জন্য কাফফারা স্বরূপ যায় যদি কবিরা গুনাহ সমূহ থেকে বেঁচে থাকা যায়।’
(মুসলিম, হাদিস : ২৩৩; ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৭৩৩)
সুতরাং আমাদের চেক করা উচিত আমরা কোন কবিরা গুনাহ করছি কি না।
মূলত কবিরা গুনাহ বলা হয় ওই সব বড় বড় পাপকর্মকে যেগুলোতে— নিন্মোক্ত কোনো একটি বিষয় পাওয়া যাবে।
◉ যেসব গুনাহের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তে জাহান্নামের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
◉ যেসব গুনাহের ব্যাপারে দুনিয়াতে নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগের কথা রয়েছে।
◉ যেসব গুনাহের ব্যাপারে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা রাগ করেন।
◉ যেসব কাজে আল্লাহ তায়ালা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ফেরেশতা মণ্ডলী লানত দেন।
◉ যে কাজের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এমনটি করবে— সে মুসলমানদের দলভুক্ত নয়।
◉ কিংবা যে কাজের ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
◉ যেসব বিষয়কে মুনাফেকির আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
◉ যে কাজে ‘দ্বীন নাই’ ও ‘ঈমান নাই’ ইত্যাদি বলা হয়েছে।
◉ অথবা যে কাজকে আল্লাহ তায়ালা সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় করা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি কবিরা গুনাহ (বড় পাপ) তুলে ধরা হলো।
০১. আল্লাহর সাথে শিরক করা।
০২. ফরজ ইবাদাত ত্যাগ করা।
০৩. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।
০৪. অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা।
০৬. যাদু-টোনা করা।
০৭. এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা।
০৮. জিহাদের ময়দান থেকে থেকে পলায়ন।
০৯. সতী-সাধ্বী মু‘মিন নারীর প্রতি অপবাদ দেওয়া।
১০. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া।
১১. অহংকার করা।
১২. চুগলখোরি করা (ঝগড়া লাগানোর উদ্দেশ্যে একজনের কথা আরেকজনের নিকট লাগোনো)।
১৩. আত্মহত্যা করা।
১৪. আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা।
১৫. অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ ভক্ষণ করা।
১৬. উপকার করে খোটা দানের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া।
১৭. মাদক বা নেশা দ্রব্য গ্রহণ করা।
১৮. মদ প্রস্তুত ও প্রচারে অংশ গ্রহণ করা।
১৯. জুয়া খেলা।
২০. অদৃশ্যের খবর জানার দাবী করা।
২১. পেশাব থেকে পবিত্র না থাকা।
২২. রাসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নামে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করা।
২৩. মিথ্যা কথা বলা, প্রতারণা করা।
২৪. মিথ্যা কসম খাওয়া।
২৫. জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।
২৬. কোন অপরাধীকে আশ্রয় দান করা।
২৭. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশু জবেহ করা।
২৮. ওজনে কম দেওয়া।
২৯. জমিনের সীমানা পরিবর্তন করা বা পরের জমি জবর দখল করা।
৩০. গিবত তথা অসাক্ষাতে কারো দোষ চর্চা করা।
৩১. পুরুষের নারী বেশ ধারণ করা।
৩২. নারীর পুরুষ বেশ ধারণ করা।
৩৩. বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কামনার দৃষ্টিতে তাকানো।
৩৪. কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করা।
৩৫. পথিকের প্রয়োজনে পানি না দেওয়া (এক্সট্রা থাকতে)
৩৬. মুসলিম শাসকের সাথে কৃত আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করা।
৩৭. চুরি ডাকাতি করা।
৩৮. সুদ লেন-দেন করা, সুদ লেখা বা তাতে সাক্ষী থাকা।
৩৯. ঘুষ লেন-দেন করা।
৪০. স্ত্রীর পায়ু পথে যৌন ক্রিয়া করা।
৪১. জুলুম-অত্যাচার করা।
৪২. অস্ত্র দ্বারা ভয় দেখানো বা তা দ্বারা কাউকে ইঙ্গিত করা।
৪৩. রিয়া বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ আমল করা।
৪৪. সোনা রুপার পাত্র ব্যবহার করা
৪৫. পুরুষের রেশমি পোশাক এবং স্বর্ণালংকার পরিধান করা।
৪৬. সাহাবিদেরকে গালি দেওয়া।
৪৭. নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে গমন করা।
৪৮. মনিবের নিকট থেকে কৃতদাসের পলায়ন করা
৪৯. ভ্রান্ত মতবাদ জাহেলি রীতিনীতি অথবা বিদআতের প্রতি আহবান করা।
৫০. পবিত্র মক্কা ও মদিনায় হারামে কোনো অপকর্ম বা দুষ্কৃতি করা।
৫১. আল্লাহর ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করা।
৫২. বিনা প্রয়োজনে তালাক চাওয়া।
৫৩. স্বামীর অবাধ্য হওয়া।
৫৪. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করা।
৫৫. বেশী বেশী অভিশাপ দেওয়া।
৫৬. বিশ্বাসঘাতকতা করা।
৫৭. ওয়াদা অঙ্গীকার পূরণ না করা।
৫৮. আমানতের খিয়ানত করা।
৫৯. শরীরে উল্কি অঙ্কন করা বা ট্যাটু করা।
৬০. ঋণ পরিশোধ না করা।
৬১. শিরকি তাবিজ-কবজ, রিং, সুতা ইত্যাদি ঝুলানো।
৬২. ইচ্ছাকৃত ভাবে জেনে শুনে অন্যায় বিচার করা।
৬৩. আল্লাহ বিধান ব্যতিরেকে বিচার-ফয়সালা করা।
৬৪. পার্থিব উদ্দেশ্যে দীনী ইলম (দীনের জ্ঞান) অর্জন করা।
৬৫. কোন ইলম (দীনের জ্ঞান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জানা সত্যেও তা গোপন করা।
৬৬. নিজের পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে দাবী করা।
৬৭. আল্লাহর রাস্তায় বাধা দেওয়া।
(৭) অধিক পরিমাণে নেক আমল করা
এই দিনগুলো বছরের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ, তাই অধিক পরিমাণে নেক আমল করা।

রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
‘‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট যিলহজ্জর (প্রথম) দশ দিনের আমলের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই।’’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ রাস্তায় জিহাদও কি এর চেয়ে উত্তম নয়?’ তিনি বললেন, ‘‘না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং এর কোনো কিছু নিয়েই আর ফিরে এলো না (অর্থাৎ, শহীদ হয়ে গেলো, তার কথা ভিন্ন)।’’
[বুখারি ৯৬৯; আল-মুসনাদ আহমাদ ৬৫০৫; আবু দাউদ ২৪৩৮]
এই দশদিনের ফরজ ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের তুলনায় অধিক মর্যাদার। এই দশদিনের নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই আমাদের পক্ষে যার যে ভালো কাজ করা সম্ভব সেটাই যেন আমরা করি। কারণ এই মাসের আমলের ফজিলত এত বেশি তা যে কোনো সাধারণ আমলকেও অসাধারণ বানিয়ে ফেলে।
[ইবনু রজব, ফাতহুল বারি: ৯/১৫]
আল্লাহ তা’আলা আমাদের ইলমে, আমলে বারাকাহ দিন। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যান দান করুন।